সোমবার, ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সন্তানের জন‍্য কর্তব‍্য করাকে মহান করে দেখানোটা অবান্তর

শীলা চক্রবর্তী 


আমার  মা বাবারা ঠিক কতোটা বুঝি ?? জীবনে অসংখ‍্যবার এইসব শুনে শুনেই সন্তানের  কেটে যায় , “জানিস , তোর জন‍্য এই করেছি সেই করেছি” !! এর পেছনে প্রচ্ছন্ন থাকে , তুমিও আমার জন‍্য এই এই করো !! কর্তব‍্যবোধটা ভেতর থেকে আসার বিষয় , ও কারোকে জোর করে ধরে গিলিয়ে দেওয়া যায়না । বাবা মায়েরা যাই করেন , কর্তব‍্য হিসেবেই করেন, সন্তানকে দয়া করেন না , এটাই সবার আগে বুঝতে হবে ।
সন্তানের জীবনে চাপ তৈরি করাটা অজান্তেই কিছু বাবা মা কর্তব‍্য হিসেবে নিয়ে ফেলেন । “ভালোর জন‍্য‌ই তো করছি” ভেবে করতে যান , করে ফেলেন হিতে বিপরীত !! পেরেন্টিং অত‍্যন্ত কঠিন একটি বিষয় , নিজে মা হবার পর আরো বুঝছি , দিনদিন সেটা আরো কঠিন হয়ে উঠছে । শিশুকে বড় করবার সময় একরকম ব‍্যাপার, অ্যাডোলেসেন্ট ছেলেমেয়ের সাথে ব‍্যবহার করতে তো ভীষণ সাবধান থাকতে হয় …  আমাদের প্রজন্মকে বুঝতে হচ্ছে, সন্তান‌ও মানুষ , তাকে তার স্পেসটা দিয়েই বড় করতে হবে … যেটা আমাদের আগের প্রজন্মদের ততোটাও বোঝবার দায় ছিলোনা , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ।
আপনি হয়তো ভেবেছেন , সন্তানের জন‍্য খুব ত‍্যাগ করেছেন , না খেয়ে তাকে খাইয়েছেন , জান লড়িয়ে ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন , ভালো রেজাল্টের জন‍্য গাদা টিউটর ঠুসেছেন , অমুক একাডেমি তমুক সেন্টারে নিয়ে দৌড়েছেন , তবু সে “মনের মতোন” হলোনা !! এইযে আপনার মনের মতোন হ‌ওয়ার আশাটা, এটাই সন্তানের জন‍্য ভীষণ চাপের । মানুষ কোনো নকুড়ের সন্দেশ নয় যে একটার ছাঁচে আরেকটা হবে !!
শিশুকে অপরিণত অবস্থায় মূল‍্যবোধ বা নৈতিকতার পাঠ দেয়া একরকম, আর পরিণত বয়স অবধিও বিক্রমের ঘাড়ে বেতালের মতো চড়ে বসে তাকে প্রতিটি বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করে যাওয়া অন‍্য কথা – দুটো বিষয় এক নয় , গুলিয়ে ফেলবার নয় । একটা বয়সের পর একটু ভরসা করে ছেড়ে দিতেই হয় , ন‌ইলে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা জীবনেও হবেনা শুধু এইই নয় , বাবা মায়ের সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি হবে ।
বাবা মায়েরা যতোই বলুন , সন্তানের থেকে কিছু আশা করিনে , আসলে কর্তব‍্যবোধ , আনুগত‍্য , অনুসরণ অনুকরণ সবটাই অবচেতনে আশা করেন । আমাদের উপমহাদেশীয় বোধ সন্তানকে সম্পত্তি হিসেবে দেখতে শেখায় , সাব‌অর্ডিনেট হিসেবে দেখতে শেখায় । মহাকাব‍্য থেকে কথকতা , সবখানেই এই ধারণার‌ই জয়জয়াকার !! যাঁরা এই “শিক্ষা” কে নিজেদের ভেতরের শিক্ষা দ্বারা আনলার্ন করে সন্তানকে মানুষের মর্যাদা দিতে পারেন , আর যাই হোক, তেমন বাবামাকে সন্তানরা অশ্রদ্ধা করতে শেখেনা অন্তত বোধহয় ।
ত‍্যাগ জিনিসটা মহিমান্বিত করবার স্বভাবটা আমাদের মজ্জাগত । সন্তান থেকে শুরু করে আরাধ‍্য অবধি সবাইকে খুশি করতে ত‍্যাগের বা কৃচ্ছসাধনের তুলনা মেলা ভার !! আর এই ত‍্যাগের পেছনে যে দেখনাইটা থাকে সেটা আমরা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলি । “দেখো, আমি করেছি , অত‌এব আমি মহান” – এইযে আত্মরতি , এইটের লোভ ছাড়তে পারাটা অসম্ভবের কাছাকাছি !! সন্তানের ভালোর জন‍্য ত‍্যাগ করতে পারলে ভালো, কিন্তু অহোরাত্র তার কানের কাছে এই করেছি সেই করেছি বলে তার ওপর চাপ তৈরি করা বা তার চোখে মহান সাজতে চাওয়াটা ঠিক সুরুচির পরিচয় নয় । মহান ইমেজের যে লোভ , এইটে ছাড়তে পারার লড়াইটা আসলে ভীষণ কঠিন , ভীষণ !!
সব কথা নিজেকেই বলি মূলত । সন্তানের কানের কাছে  অহরহ মানুষ হ‌ও মানুষ হ‌ও জপ করবার আগে, নিজে যেন একটু মানুষ হতে পারি , “গাজ্জেন” হবার আগে । ওটা ভীষণ জরুরী , সন্তানের মঙ্গলের জন‍্য‌ও , নিজের‌ও ।


লেখক পরিচিতি : শীলা চক্রবর্তী 
                         লেখক,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
                            কলকাতা।

Comments are closed.

More News Of This Category